শক্রবার ০৭ নভেম্বার ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বঙ্গাব্দ
জাতীয়

বুকে গুলি নিয়ে ৩৯ দিন, অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানলেন শোহান

নবীন নিউজ, ডেস্ক ৩১ আগষ্ট ২০২৪ ১২:৪৯ পি.এম

সংগৃহীত ছবি

অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরেছিলেন শোহান শাহ। মা-বাবা, স্ত্রী ও স্কুলছাত্র ছোট ভাইয়ের সব খরচের জোগান আসত একজনের বেতন থেকেই। পরিবারের সবার ভরসার শোহান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। বুকে বুলেট নিয়ে ৩৯ দিন লড়াই করে হার মেনেছেন তিনি। এখন পরিবারের সদস্যরা পড়েছেন অকুল পাথারে।

শোহান শাহের (২৯) বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা সদরে আলতাফ হোসেন মহিলা কলেজ রোড এলাকায়। অর্থ সাশ্রয়ের জন্য স্ত্রীকে বাড়িতে মা-বাবার কাছে রেখে ঢাকায় মেসে থেকে চাকরি করছিলেন। গ্রামের বাড়িতে নতুন ঘর নির্মাণ করা হচ্ছিল। যেখানে স্ত্রী শম্পা বেগমের সঙ্গে সুখের সংসার পাততে চেয়েছিলেন শোহান শাহ। তবে তাঁদের সেই স্বপ্ন অপূরণ থেকে গেল। গত ১৯ জুলাই ঢাকার রামপুরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন শোহান। এর ৩৯ দিন পর ২৭ আগস্ট ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। গত বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শোহানের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে ওই দিন বিকেলে শ্রীপুর গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।


বৃহস্পতিবার বিকেলে শ্রীপুরে শোহানদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর স্ত্রী শম্পা বেগমের বিলাপ কিছুতেই থামছে না। পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বারবার বলছেন, শোহানকে ছাড়া এখন একা কীভাবে বাঁচবেন?

শম্পা বেগম বলেন, তাঁদের বিয়ে হয়েছিল ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। এরপর মধ্যে তিন বছর দুজন একসঙ্গে ঢাকায় সংসার পেতেছিলেন। বাকি সময় স্ত্রীকে গ্রামে পরিবারের সঙ্গে রেখে ঢাকায় চাকরি করেছেন শোহান। শম্পা বেগম বলেন, ‘আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। অর্থসংকটের কারণে ও একা ঢাকায় থাকত। অর্থের কারণে দুজন একসঙ্গেও থাকতে পারিনি। গত এক বছর বাড়িতে একটা নতুন ঘর দিচ্ছিল। সে আমাকে বলেছিল, “শম্পা, আমি আর তুমি এই ঘরে থাকব।”’

গত মঙ্গলবার ঢাকায় সিএমএইচে স্বামীর সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল শম্পার। তখন শোহান শম্পাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কেঁদো না। আমার কিছুই হবে না।’ তবে শোহান আর ফেরেননি। অস্ত্রোপচার করে শরীর থেকে বুলেট বের করা গেলেও রক্ত বন্ধ করা যায়নি। ১৮ ব্যাগ রক্ত দিয়েও বাঁচানো যায়নি শোহানকে। সংসারে অভাব থাকলেও ভালোবাসার কমতি ছিল না উল্লেখ করে শম্পা বলেন, ‘স্বামী ছাড়া কেউ ছিল না আমার। সে সব সময় সব ধরনের পরিস্থিতিতে আমার পাশে থেকেছে। সে বলত, “চিন্তা করো না, আমি তোমার পাশে আছি।” আল্লাহ আমাকে একটা সন্তানও দেননি। আমি এখন কীভাবে বাঁচব?’

মাগুরার শ্রীপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে প্রায় ১০ বছর আগে সংসারের হাল ধরতে চাকরিতে যান শোহান। সবশেষ ঢাকার রামপুরা এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। তাঁর বাবা শাহ সেকেন্দার এক দশকের বেশি সময় আগে নিজের ব্যবসা গুটিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। তাঁর একমাত্র ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।

শাহ সেকেন্দার বলেন, ‘আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই স্মার্ট, কর্মঠ আর দায়িত্বশীল। ছোটবেলা থেকেই ইনকাম করে। বিশেষ করে বিয়ের পর একদিনও বসে থাকেনি। চাকরি না থাকলে বাড়িতে এসে রাজমিস্ত্রির কাজও করেছে। আমার পকেটখরচও সে দিত। যেদিন মারা গেল সেদিন সকালেও বিকাশে আমাকে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে বলল, এই টাকাটা তুলে চলে আসেন।’

ছেলে হারানোর শোকে বিলাপ করছিলেন শোহানের মা সুফিয়া বেগমও। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে আমার মনের কথা বুঝত। কোনো কথা লুকালে ও বুঝে ফেলত। টাকা পাঠিয়ে বলত, “মা তুমি আঁচলে গুঁজে রেখো না, যা লাগে কিনে খাও আমি আছি তো। আমার ইনকাম না খেয়ে তোমাদের মরতে দেব না।”’ সুফিয়া বেগম বলেন, ‘এখন এই কথা আমাকে কে বলবে? সবাই আছে শুধু আমার ছেলে নেই।’

শোহান শাহ গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটের দিকে রামপুরা সিএনজি পাম্প এলাকায়। তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন দুই সহকর্মী ওলিউল ইসলাম ও নূর হোসেন। সেদিন আন্দোলনে যাওয়ার বিষয়ে ওলিউল ইসলাম  বলেন, ‘চোখের সামনে অনেক ছাত্র ভাইদের মরতে দেখছিলাম। আমরা ঘরে বসে থাকতে পারিনি।’

সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা জানান, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর শোহানকে প্রথমে বেটার লাইফ হাসপাতালে নিয়ে যান দুই সহকর্মী। সেখান থেকে তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে এক্স-রে করে বুকে গুলি থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু সেখানে কর্তৃপক্ষ ভর্তি নেয়নি। পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য অনুযায়ী, তখন ঢাকা মেডিকেলেও সংঘর্ষ চলছিল। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা আহতদের ওপর নির্যাতন করছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে সেখান থেকে একপ্রকার পালিয়ে আসেন তাঁরা। এরপর আরও কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরে গুলিবিদ্ধ শোহানকে ভর্তির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন পরিবারের সদস্যরা। প্রায় ১২ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্সে ঘুরে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শোহানকে। সেখানে ওই দিনই ছোট একটা অস্ত্রোপচার করা তাঁর। তবে গুলি শরীরে থেকে যায়।


শোহানের সহকর্মী ওলিউল ইসলাম বলেন, গত ২২ জুলাই বক্ষব্যাধি হাসপাতালে শোহানকে অক্সিজেন নিতে সহযোগিতা করছিলেন। এমন সময় পুলিশ এসে ‘জামায়াত-শিবির’ বলে লাঠি দিয়ে বাড়ি দেয়। বাইরে বসে থাকা আরেক সহকর্মী নূর ইসলামকেও লাঠিপেটা করা হয়। এরপর ওলিউল ইসলামকে আটক করে বনানী থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে ৪ ঘণ্টা আটক থাকার পর মুক্তি পান তিনি।

পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য শোহানকে ভারতে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁরা। এর জন্য পাসপোর্ট করতে গিয়ে নানা রকম বাধার মুখে পড়তে হয়। এমনকি শোহান যখন ঢাকায় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি তখন তাঁর বাবা স্থানীয়দের মাধ্যমে জানতে পারেন শ্রীপুর থানায় করা নাশকতার একটি মামলায় তাঁর ছেলেকে আসামি করা হয়েছে।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ জুলাই শ্রীপুর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে একটি মামলা করেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আবদুল খালেক। সেখানে আসামি হিসেবে ৯৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি দেখানো হয় ১৫০ থেকে ২০০ জনকে। মামলার এজাহারে ১৮ নম্বর আসামি হিসেবে নাম রয়েছে শাহ সেকেন্দারের (এজাহারে সেকেন্দার শাহ লেখা হয়েছে) ছেলে শোহানের। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ওই দিন (২৪ জুলাই) সকাল ৬টার দিকে শ্রীপুরের আলতাফ হোসেন মহিলা কলেজ মাঠে জড়ো হয়ে ককটেল বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির করছিলেন আসামিরা।

শাহ সেকেন্দার বলেন, ‘আমার ধারণা, ওর গুলি লেগেছে, এটা জেনেই এলাকার লোকজন ও পুলিশ ষড়যন্ত্র করে মামলায় তাঁকে আসামি করেছে। আমার ছেলেকে গুলি করা থেকে শুরু করে চিকিৎসায় বাধা দেওয়া, মিথ্যা মামলা দেওয়া সব অপরাধের ন্যায়বিচার চাই আমি।’

নবীন নিউজ/জেড

এই সম্পর্কিত আরও খবর

আরও খবর

news image

পাঁচ দাবিতে জামায়াতসহ ৮ সমমনা দলের পদযাত্রা

news image

নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জামায়াতসহ ৮ দল

news image

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে ৬ষ্ঠ দিনের আপিল শুনানি চলছে

news image

প্রবাসীদের ভোটে নজর বিএনপির

news image

এক লাফে স্বর্ণের ভরিতে বাড়ল প্রায় ৯ হাজার টাকা

news image

রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের ১০ সদস্য আটক

news image

ফার্মগেটের কাছে ‘কম্পন’, আগারগাঁও–শাহবাগ অংশে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ

news image

‘বিএনপি ক্ষমতায় আসলে মা-বোনদের আর নির্যাতিত হতে হবে না’

news image

হাসিনার মামলার রায়ের দিন ধার্য হতে পারে আজ

news image

বিএনপির বন্ধু আছে, প্রভু নেই : ডা. জাহিদ

news image

‘আমাকে কুকুরের মত টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায় পুলিশ, জানি না কীভাবে ছাত্রদের সামনে দাঁড়াব’

news image

জবি ছাত্রদল নেতা খুন: রাত শেষে সকাল হলেও থানায় হয়নি মামলা

news image

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে যা বললেন ইসি আনোয়ারুল

news image

নোয়াখালীতে বিএনপি ও শিবির নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ, আহত ৪০

news image

জামায়াতের পিআর পদ্ধতির আন্দোলন পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতারণা

news image

জুলাই সনদে এনসিপি কেন স্বাক্ষর করেনি, জানালেন আখতার হোসেন

news image

করোনা ভাইরাসের মতো পিআর নামক ভাইরাস থেকে মুক্তি চাই

news image

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান পেছাল

news image

টাকা খরচ করে এমপি হতে চায় ব্যবসার জন্য: হাসনাত আব্দুল্লাহ

news image

নাম বদলের খেলায় বিপদে দেশ

news image

বিসিবি নির্বাচন নিয়ে ‍মুখ খুললেন ইশরাক

news image

পাচার হওয়া সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান ড. ইউনূসের

news image

মাহিন সরকারের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার

news image

প্রায় ৪ কোটি টাকার হেরোইন ফেলে চোরাকারবারিদের নদীতে ঝাঁপ

news image

‘নিখোঁজ’ মামুনুর রশিদকে ফেরত চান জামায়াত আমির

news image

এবার মির্জা ফখরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সেই ছবি প্রকাশ করল ‘এই সময়’

news image

ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত

news image

বাংলাদেশ দূতাবাস রাবাতে ই-পাসপোর্ট সেবার উদ্বোধন

news image

খাওয়া ও বিশ্রামে ব্যস্ত, ৩ পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার

news image

কিশোরগঞ্জে বিএনপির সম্মেলন ঘিরে সাজ সাজ রব, ফজলুর রহমানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী?